সোমবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২১

২৫ দিন পড়েছিল মর্গে, অবশেষে মেয়ের লাশ পেলেন বাবা-মা

 


আইনি জটিলতার কারণে ২৫ দিন ধরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মর্গে পড়েছিল লাকিংমে চাকমার লাশ। অবশেষে আদালতের নির্দেশে সোমবার মেয়ের লাশ বুঝে পেয়েছেন বাবা-মা।

এদিন বিকেলে হাসপাতাল মর্গ থেকে লাশটি বাবা-মার কাছে হস্তান্তর করেন র‌্যাব সদস্যরা। অপহরণের প্রায় এক বছর পর গত ৯ ডিসেম্বর লাকিংমে চাকমাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়ানের এসআই অর্জুন চৌধুরী এবং লাকিংমের বাবা-মাসহ স্বজনদের উপস্থিতিতে লাশটি বুঝে নেন তার চাচাতো ভাই ক্যচিং মং চাকমা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সদর হাসপাতালের আরএমও শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী।

এর আগে মর্গের ভাড়া বাবদ ২৪ হাজার টাকা দাবি করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। লাকিংমের পরিবার অসহায় ও দরিদ্র হওয়ায় ওই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। পরে বিষয়টি জেনে র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান র‌্যাবের পক্ষ থেকে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা করেন। এরপর লাশ হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এসআই অর্জুন চৌধুরী বলেন, তদন্তে লাকিংমে চাকমার বয়স নাবালিকা অর্থাৎ প্রচলিত আইনে বিয়ের উপযুক্ত হয়নি বলে প্রমাণ হয়েছে। বিয়ে হলেও তা আইনিভাবে অবৈধ। তাই সার্বিক বিবেচনায় ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য বাবা-মার লাশ কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি একটি অপহরণ মামলা হিসেবে আদালতে বিচার কাজ চলবে।

হাসপাতালের আরএমও শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লাকিংমে চাকমাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন কয়েকজন যুবক। ওই সময় যুবকরা চিকিৎসকদের জানান রোগী বিষপান করেছেনে। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি পুলিশকে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর পুলিশ লাকিংমের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে মর্গে পাঠায়। ১০ ডিসেম্বর তার লাশের ময়নাতদন্ত শেষ করা হয়।

এর মধ্যে নিজের স্ত্রী দাবি করে লাশ তাকে হস্তান্তরের জন্য পুলিশে আবেদন করেন আতাউল্লাহ নামে এক যুবক। তবে মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা লালা অং চাকমাও হাসপাতালে ছুটে এসে মেয়ের লাশ পাওয়ার আবেদন জানান। শুরু হয় আইনি জটিলতা।

১৫ ডিসেম্বর মেয়ের লাশ হস্তান্তরের জন্য টেকনাফ বিচারিক হাকিম আদালতে আবেদন জানান লালা অং চাকমা। শুনানি শেষে আবেদনটি গ্রহণ করে লাকিংমের ধর্ম পরিচয় নিশ্চিত হয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য র‌্যাবকে দায়িত্ব দেন বিচারক।

আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মংথেলা রাখাইন জানান, ২৮ ডিসেম্বর মানবাধিকার কর্মীদের একটি দল টেকনাফে লাকিংমে চাকমার বাড়িতে যান। তারা পরিবার, গ্রামবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরদিন দলটি লাকিংমের বাবার উপস্থিতিতে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন।

টেকনাফ উপজেলার সাগর উপকূলবর্তী ইউনিয়ন বাহারছড়ার শীলখালীর অরণ্যভরা আদিবাসী গ্রাম চাকমা পাড়ায় লাকিংমের বাবা অসহায় দরিদ্র লালা অং চাকমার বসবাস।

লালা অং জানান, ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি তার মেয়ে লাকিংমেকে একই ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা এলাকার আতাউল্লাহসহ চার-পাঁচ যুবক অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তিনি ঘটনার দিনই অপহরণের বিষয়টি স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে জানান আর মেয়েকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ইউপি সদস্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেননি। এরপর তিনি বিভিন্ন জায়গায় মেয়েকে খুঁজতে থাকেন।

আতাউল্লাহর স্বজনদের সঙ্গে ও দেনদরবার করেন। এতেও ফিরে পাননি মেয়েকে। তিনি টেকনাফ থানায় গিয়ে অপহরণের মামলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই সময়ে টেকনাফ থানায় কর্মরত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মামলা না নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেন। ২৭ জানুয়ারি তিনি জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন নিজেই। ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে আদেশ দেন।

লালা অং চাকমা তার মামলার আরজিতে উল্লেখ করেছেন, তার মেয়ে এখনো বয়সে শিশু। জন্মসনদ অনুযায়ী তার মেয়ের বয়স মাত্র ১৪ বছর ১০ মাস। ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন শাখার ইস্যুকৃত সনদ মতে, লাকিংমের জন্ম ২০০৫ সালের ২ মার্চ। তিনি বয়স প্রমাণের কাগজপত্রও আদালতে জমা দেন। তার মেয়ে নাবালক এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার মেয়ের বিয়ের বয়স হয়নি। সে নিজের ইচ্ছায় যায়নি, তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আতাউল্লাহরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

আদালতের আদেশে ৯ আগস্ট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক ক্যশেনু মারমা তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। তিনি বলেন, এ মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিও নেয়া হয়েছে। পাঁচজন সাক্ষীই ভুক্তভোগী লাকিংমের আত্মীয়। ওই পাঁচজন ছাড়া কেউ লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছে এমন বলেননি। তাই লাকিংমে স্বেচ্ছায় চলে গেছে মর্মে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

২৮ ডিসেম্বর লাকিংমে চাকমার গ্রাম পরিদর্শনে যাওয়া মানবাধিকার কর্মী দলের অন্যতম সদস্য কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারাহ তানজিম টিটিল বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এবং লাকিংমের বয়স সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র সচক্ষে যাছাই-বাছাইয়ে দুটি বিষয় পুরোপুরি স্পষ্ট হয়েছে। লাকিংমে নিজ ইচ্ছায় কারো সঙ্গে যায়নি, সে পরিকল্পিত অপহরণের শিকার। দ্বিতীয়ত দেশের প্রচলিত আইনে সে নাবালক এবং তার বিয়ের বয়স হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে নারাজি দিয়েছেন নিহতের বাবা লালা অং চাকমা। এ বিষয়ে আদালত পরবর্তী শুনানির তারিখ ২৮ জানুয়ারি নির্ধারণ করেছে বলে জানিয়েছেন বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ মহি উদ্দীন খান। লাকিংমে মারা যাওয়ার মাত্র ১৩ দিন আগে জন্ম দেয় এক ছেলে সন্তান। নবজাতক বর্তমানে আতাউল্লাহর মায়ের কাছে রয়েছে।


শেয়ার করুন

Author:

[সংবাদ, নরম এবং কেবল প্রচার নয়। সাধারণ মানুষের বাস্তব প্রত্যাশা] [সাংবাদিকতা কখনও নীরব হতে পারে না: এটি তার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ এবং তার সর্বশ্রেষ্ঠ] “আমরা শুধু সামনের দিকেই এগুতে পারি; আমরা নতুন দরজা খুলতে পারি, নতুন আবিষ্কার করতে পারি – কারণ আমরা কৌতুহলী। আর এই কৌতুহলই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা”

0 coment rios:

ধন্যবাদ কমেন্ট করার জন্য